বিশেষ প্রতিনিধি : ২০২৪ সালের ২৬ জুলাই। দিনটি ছিল শুক্রবার। দেশব্যাপী চলমান কার্ফিউ শিথিল করা হয় সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। দেশের বিভিন্নস্হানের মতো গেলো কয়েকদিনের ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকার সাভার ও ধামরাই উপজেলায় ছিল থমথমে পরিস্থিতি। হতাহতের ঘটনায় গুমোট পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় আন্দোলনকারীদের মাঝে। চাপা ক্ষোভ নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন ফের আন্দোলনে নামার জন্য। আন্দোলনকারীরা রাজপথে না থাকলেও পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কায় সকাল থেকেই শিথিল হওয়া কার্ফিউর মধ্যেই ঢাকা-আরিচা ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্হান নেয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
এরইমধ্যে সাভার উপজেলায় চাঞ্চল্যকর মেধাবী শিক্ষার্থী ইয়ামিনসহ প্রকাশ্য দিবালোকে প্রায় ১০জনের মৃত্যু ঘটে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ছোড়া গুলিতে। শহীদদের রক্তের বদলা নিতে একাট্টা হয় আন্দোলনকারীরা। চলমান আন্দোলনের রেশ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ফুসে উঠে সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। এরআগে সাভার পশু হাসপাতালসহ সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডস্হ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্হানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ চালিয়ে রাজপথ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা।
বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে সাভারের ক্ষতিগ্রস্হ স্হাপনা আগেরদিন ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার সাভারে সরেজমিনে পরিদর্শনে আসেন ভয়ে তটস্হ ঢাকা রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামসহ পুলিশের উর্ধত্তন কর্মকর্তারা। অধস্তন কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে ওইদিন দুপুরে তিনি সাভার মডেল থানায় এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের বিএনপি-জামাত ও উচ্ছেদকৃত হকার বলে উল্লেখ করে চলমান আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলন বলে অভিহিত করেন।
সাভারের চলমান ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনকে ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করার পায়তারা উল্লেখ করে অধস্তন কর্মকর্তাদের যেকোন মূল্যে আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করার নির্দেশনা দেন তিনি। এ ঘটনায় আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে আন্দোলনকারী বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তারা।
এদিন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতদের তালিকা তৈরী, হত্যা ও হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলো খুলে দেওয়ার চাপ তৈরি করাসহ ৮ দফা দাবী পেশ করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্লাটফমর্ম বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য এসব বার্তা দেন তারা।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতা’র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া সাভার পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ন আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল ইসলামের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে জুলাই যোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মনিরুল ইসলাম বাসস’কে বলেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক এ আন্দোলনের শুরু থেকেই আমাদের সমর্থন ও সম্পৃক্ততা ছিলা। তিনি বলেন, সেদিনের সেই কথা মনে হলে এখনো গাঁ শিওরে উঠে। আৎকে উঠি মাঝে মাঝেই।
১৮ জুলাই অত্যন্ত নির্মভাবে রাজধানী মিরপুরের এমআইএসটি’র মেধাবী শিক্ষার্থী শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের নির্মম হত্যাযজ্ঞ দেখে রক্তে আগুন জ্বলে উঠে। এ দৃশ্য দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি। ওইদিন বিকেলেই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেই। ইয়ামিনের মৃত্যুর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আমার সাথে বিএনপিসহ এর সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দও আমার সাথে আন্দোলনে যোগ দেন। যোগ দেন সাধারণ মানুষও। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের পাকিজা মোড় থেকে থানা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল ও পিকেটিংয়ের মাধ্যমে রাজপথ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করি।
পরদিন একইস্হানে আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুলিবিদ্ধ হই।এদিন আমার চোখে ২টিসহ শরীরের বিভিন্নস্হানে ২২টি গুলিবিদ্ধ হয়। এরমধ্যে শরীরের ২০টি গুলি অপসারন করা গেলেও চোখের ২টি গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। কয়েকদিনের চিকিৎসা শেষে ২৬ তারিখ সকালেই শিথিল থাকা কার্ফিউর মধ্যেই পাকিজা মোড়ে ফের অবস্হান নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এরআগে গত কয়েকদিনের চলমান আন্দোলনে অংশ নেন শতশত শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। পুলিশ ও আওয়ামী ক্যাডারদের মুূহুর্মুহূ গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠে রাজপথ।
পিছ পা না হয়ে আমরা আন্দোলনের গতি বাড়াতে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলি সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী ও আওয়ামী লীগের অস্ত্রধারী ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢাকা থেকে সাভারে ছুটে আসেন পুলিশের বড় বড় পদস্হ কর্মকর্তারা। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এদিন পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী ক্যাডারদের অস্ত্রের মহড়া না দেখতে পেলেও পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব লোমহর্ষক ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে যা দেশবাসী দেখেছেন।
এভাবেই আন্দোলনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই আমরা। চলমান আন্দোলনের ফলে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় ইতিহাসের নিকৃষ্টতম স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা, পতন ঘটে স্বৈরশাসনের-যোগ করেন তিনি।
Leave a Reply