আন্তর্জাতিক ডেস্ক : অ্যাপোলোর বিরুদ্ধে কিডনি পাচার ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। শনিবার এ বিষয়ক একটি বিস্তৃত অনুসন্ধানী প্রতিবেদেনও প্রকাশ করেছে যুক্তরাজ্যের দৈনিক টেলিগ্রাফ। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে ভারতের শীর্ষ এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি হাসপাতাল অ্যাপোলো গ্রুপ কর্তৃপক্ষ। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনকে পুরোপুরি মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্যের সমাবেশ’ বলেও দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।
প্রসঙ্গত, অ্যাপোলো মূলত একটি বহুজাতিক চেইন হাসপাতাল। ভারতের রাজধানী দিল্লিসহ বিভিন্ন প্রদেশ, এমনকি বাইরের বিভিন্ন দেশেও এই হাসপাতালটির শাখা রয়েছে। দিল্লির ইন্দ্রপস্থ মেডিকেল কর্পোরেশন লিমিটেড (আইসিএমএল) হাসপাতালও এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনটিও প্রস্তুত করা হয়েছে এই হাসপাতালটিকে ভিত্তি করেই।
নিজেদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে টেলিগ্রাফ বলেছে, আইসিএমএল হাসপাতালে প্রতি বছর ১ হাজার ২০০টিরও বেশি কিডনি কেনাবেচা হয় এবং চোরাই পথে ভারতের বাইরে, এমনকি যুক্তরাজ্যেও পাঠানো হয় কিডনি। এসব কিডনি মূলত সংগ্রহ করা হয় মিয়ানমারের দরিদ্র লোকজনের শরীর থেকে। প্রতিটি কিডনির জন্য ডোনার বা দাতাকে প্রদান করা হয় ৮০ থেকে ৯০ লাখ রুপি, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ৫ লাখ ৫৭ হাজার থেকে ১ কোটি ১৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।
ভারত এবং বিশ্বের প্রায় সব দেশেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ। কিন্তু টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দালাল বা এজেন্টের মাধ্যমে অর্থের লোভ দেখিয়ে মিয়ানমারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে তরুণ-তরুণীদের দিল্লি নিয়ে আসা হয়। তারপর অ্যাপোলো বা এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত কোনো হাসপাতালে হয় অপারেশন।
অবশ্য দাতাকে অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে গড়িমসির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অপারেশনের আগে বা পরে দাতাদেরকে অর্থ বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত এক এজেন্টের সঙ্গে কথা হয়েছে টেলিগ্রাফের। তিনি বলেন, এটা একটা বিশাল ব্যবসা। এই দাতাদের আনা-নেওয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তাদের বিপুল অর্থ ঘুষ দেওয়া হয়। দিল্লিতে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাতাদের কিছু দাপ্তরিক রুটিন প্রশ্ন করে, এবং তারা (দাতা) সেসবের উত্তর দেয়। কী কী প্রশ্ন করা হবে এবং সেসবের কী জবাব দিতে হবে— এসব আগে থেকেই দাতাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়।
মিয়ানমারের এসব দরিদ্র গ্রামবাসীদের কিডনি কেনেন বড়লোক ক্রেতারা (বায়ার)। এসব বায়ারদের মধ্যে বাইরের বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ধনী বার্মিজও রয়েছেন। ৫৮ বছর বয়সী বার্মিজ নারী দাও সোয়ে সোয়ে তাদের একজন।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী দাও সোয়ে সোয়ে প্রচুর অর্থসম্পদের মালিক। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লির আইসিএমএল হাসপাতালে এসে অপারেশনের মাধ্যমে নতুন কিডনি নেন তিনি। কিডনি ক্রয় বাবদ সেসময় ডোনারকে ৩১ হাজার ইউরো, বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা দিয়েছিলেন তিনি।টেলিগ্রাফকে তিনি বলেন, আমি জানি যে মিয়ানমার এবং ভারতের আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনাবেচা নিষিদ্ধ। কিন্তু যেহেতু আমি এবং আমার ডোনার উভয়ই মিয়ানমারের, তাই অপারেশনের কাগজপত্রে বলা হয়েছে— আমরা পরস্পরের আত্মীয়।
ভারতের অন্যতম শীর্ষ চিকিৎসক এবং সার্জন ডা. সন্দ্বীপ গুলেরিয়ার সংশ্লিষ্টতার তথ্যও পাওয়া গেছে এই চক্রের সঙ্গে। দেশটির তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্ম শ্রী অর্জন করা এই চিকিৎসক কিডনি প্রতিস্থাপনসংক্রান্ত অনেকগুলো অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে দাবি করেছে টেলিগ্রাফ। ডা. গুলেরিয়া অবশ্য এই অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে বলেছেন, তার পর্যায়ের একজন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আনা হাস্যকর এবং আক্রমণাত্মক।
তবে এখানে উল্লেখ্য যে ডা. গুলেরিয়ার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে ২০১৬ সালে ভারতের সংবাদমাধ্যম ডেকান হেরাল্ড তাদের এক অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে এই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনেছিল। এবং সেই সময়েও এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার ও প্রতিস্থাপন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক চোরাই বাণিজ্যগুলোর মধ্যে একটি। যুক্তরাজ্যের সেন্ট মেরি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জানিয়েছেন বিশ্বে প্রতি ১০টি প্রতিস্থাপিত অঙ্গের একটি চোরাই পথে আসছে। এটা একটা বিশাল বৈশ্বিক বাণিজ্য। আমরা যতখানি ধারণা করছি, এই বাণিজ্যের আকার তার চেয়েও বড়।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে অ্যাপোলো কর্তৃপক্ষ বলেছে, আমাদের প্রতিটি হাসপাতাল সরকারের নির্দেশিত বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হয় এবং রোগীর ভর্তি থেকে শুরু করে চিকিৎসা, অপারেশনসহ যাবতীয় কার্যক্রমে আইন এবং চিকিৎসা শাস্ত্র সংক্রান্ত নৈতিকতার মাণদণ্ড সমুন্নত রাখাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। একটি বিদেশি পত্রিকায় সম্প্রতি যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা সর্বৈব মিথ্যা, ভুল তথ্যে পরিপূর্ণ এবং অ্যাপোলো গ্রুপের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে উদ্যেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটি করা হয়েছে।
Leave a Reply